কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত শেষ জামানার অন্যতম বড় ফিতনা হলো ইয়াজুজ ও মাজুজের আগমন। কিন্তু কারা এই ইয়াজুজ-মাজুজ? তাদের অবস্থান কোথায়? তারা কি কোনো প্রাচীরের আড়ালে বন্দী, নাকি 이미 পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে? চলুন, ঐতিহাসিক ধারণা ও আধুনিক গবেষণার আলোকে এই রহস্যময় বিষয়টি জানার চেষ্টা করি।
ঐতিহাসিক ধারণা ও ভৌগোলিক অবস্থান
ঐতিহাসিকভাবে, ইয়াজুজ-মাজুজকে এক অত্যাচারী ও ধ্বংসাত্মক জাতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক মুফাসসির ও ঐতিহাসিকের মতে, বাদশা যুল-কারনাইন ককেশাস পর্বতমালার মাঝে এক বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করে এই জাতিকে আটকে দিয়েছিলেন। অনেকে এই স্থানটিকে আজকের রাশিয়া ও জর্জিয়ার মধ্যবর্তী ‘দারিয়াল গিরিপথ’ (Darial Gorge) হিসেবে চিহ্নিত করেন।
আরেকটি ধারণা অনুযায়ী, চীনের মহাপ্রাচীরও নির্মাণ করা হয়েছিল 비슷한 ধরনের আক্রমণকারী যাযাবর জাতি, যেমন—হুন, মঙ্গল ও তাতারদের ঠেকাতে, যাদেরকে ইয়াজুজ-মাজুজের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই জাতিগুলোর প্রাচীন ইতিহাস খুব একটা পরিচিত নয়, যা যুল-কারনাইনের প্রাচীরে তাদের আটকে থাকার দিকেই ইঙ্গিত করে।
ইয়াজুজ-মাজুজ কারা? প্রাচীন উপজাতি নাকি আধুনিক পরাশক্তি?
আধুনিক গবেষকদের মধ্যে এ নিয়ে দুটি প্রধান মত পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ইতিহাসে যে মঙ্গল, তাতার বা হুনদের মতো ধ্বংসাত্মক জাতির কথা বলা হয়েছে, তারাই ছিল ইয়াজুজ-মাজুজের অংশ।
আবার, অনেক গবেষক মনে করেন, ইয়াজুজ-মাজুজ কোনো নির্দিষ্ট জাতি নয়, বরং এটি একটি প্রতীকী নাম। এটি এমন এক বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক শক্তিকে বোঝায়, যাদের মূল ভিত্তি হলো ধর্মহীন সেকুলার মতবাদ (গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র)। এই আধুনিক পরাশক্তিগুলোই আজ পারমাণবিক অস্ত্রের মতো বিধ্বংসী প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে এবং বিশ্বজুড়ে ফেতনা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে।
হাদিসের আলোকে তাদের সংখ্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ
হাদিস অনুসারে, ইয়াজুজ-মাজুজের সংখ্যা হবে অগণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ যখন আদম (আঃ)-কে বলবেন জাহান্নামীদের বের করতে, তখন প্রতি এক হাজারে ৯৯৯ জনই হবে ইয়াজুজ-মাজুজের মধ্য থেকে (সহিহ বুখারি: ৬৫৩০)। আজকের বিশ্বের দিকে তাকালে ধর্মহীন সেকুলার মতবাদের অনুসারীদের সংখ্যা এই হাদিসের সাথে মিলে যায়।
তারা পৃথিবীতে বেরিয়ে এসে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। তারা নদী-নালার পানি শুকিয়ে ফেলবে, ফসল ও সম্পদ নষ্ট করবে এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটাবে। হাদিসে আরও এসেছে, তারা আসমানের দিকে তীর ছুঁড়ে বলবে, "আমরা জমিনের অধিবাসীদের পরাজিত করেছি, এবার আসমানের অধিবাসীদের সাথে লড়ব।" যা বর্তমান পরাশক্তিগুলোর মহাকাশ অভিযানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
তাদের চূড়ান্ত পরিণতি এবং আমাদের জন্য শিক্ষা
তারা যখন ঈসা (আঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে, তখন আল্লাহ্ তাদের উপর এক ধরনের রোগ বা কীটপতঙ্গ পাঠাবেন, যার মাধ্যমে তারা সবাই একযোগে ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর এক প্রবল বৃষ্টিতে পৃথিবী তাদের মৃতদেহ থেকে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে। ঈসা (আঃ) ৪০ বছর ধরে ইসলামের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব শাসন করবেন।
ইয়াজুজ-মাজুজের এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, পৃথিবীর ক্ষমতা বা সম্পদ চিরস্থায়ী নয়। কেয়ামতের আলামতগুলো একের পর এক প্রকাশিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত ঈমানদাররাই সফল হবে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো ফিতনার এই যুগে নিজের ঈমানকে রক্ষা করা এবং আল্লাহ্র দেখানো পথে অবিচল থাকা।