একটি দেশ, যার কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারা কীভাবে হঠাৎ করে প্রকৃতির কাছে ফিরে এলো? শুধু তাই নয়, পাখিকে নিজেদের সবচেয়ে বড় বন্ধু বানিয়ে পুরো কৃষি ব্যবস্থায় এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললো। চলুন, দ্বীপদেশ কিউবার এই অসাধারণ গল্পটি জেনে নেওয়া যাক।
রাসায়নিকের ফাঁদে যেভাবে জড়ালো কিউবা
একসময় কিউবার কৃষি ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং স্বনির্ভর। কিন্তু ১৯ শতকের শেষে এবং ২০ শতকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে সেখানে ধীরে ধীরে রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং মেশিন-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হয়। "সবুজ বিপ্লব" (Green Revolution) এবং পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীলতা কিউবাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে রাসায়নিক ছাড়া চাষাবাদের কথা কল্পনাই করা যেত না। কিউবা তাদের প্রয়োজনীয় সব সার, কীটনাশক, জ্বালানি এবং যন্ত্রপাতি পেত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, আর বিনিময়ে দিত চিনি।
এক সংকটে বদলে গেল সবকিছু
এই ব্যবস্থা বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। এর সাথে সাথেই কিউবায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং জ্বালানির সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশজুড়ে বিশাল এক খাদ্য সংকট তৈরি হয়, কারণ রাসায়নিক ছাড়া ফসল উৎপাদন लगभग অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তখন কিউবার সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা ছিল— হয় বিদেশ থেকে চড়া দামে খাদ্য কেনা, অথবা নিজেদের দেশেই প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল ফলানো। তারা দ্বিতীয় এবং কঠিন পথটিই বেছে নেয়।
প্রকৃতির কাছে ফেরা এবং পাখির সাথে বন্ধুত্ব
বাধ্য হয়ে কিউবার কৃষকরা জৈব এবং প্রাকৃতিক চাষাবাদে ফিরে আসে। তারা রাসায়নিক সারের বদলে কম্পোস্ট ও জৈব সার ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কীটনাশক ছাড়া পোকার হাত থেকে ফসল বাঁচানো। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়েই তারা এক চমৎকার কৌশল বের করে ফেলে।
তারা খেয়াল করলো, পাখিরা ফসলের যেমন ক্ষতি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি উপকার করে ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে। তাই তারা মূল ধান বা ভুট্টার ক্ষেতের পাশেই পাখিদের জন্য ছোট্ট একটি আলাদা জমি উৎসর্গ করলো। পাখিদের জানিয়ে দেওয়া হলো, ওই জমির ফসল তারা ইচ্ছেমতো খেতে পারবে, কিন্তু মূল জমিতে বসতে দেওয়া হবে না। কয়েক মৌসুম যেতেই পাখিরা এই নিয়মটি বুঝে ফেললো। তারা উৎসর্গ করা জমি থেকে শস্য খেত, আর বাকি বিশাল জমিতে ঘুরে ঘুরে শুধু পোকা শিকার করত। এতে কীটনাশকের আর কোনো প্রয়োজনই রইলো না!
যেভাবে কৃষকের বন্ধু হয়ে উঠলো পাখিরা
কিন্তু একটি সমস্যা ছিল, বছরের পর বছর রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে প্রকৃতি থেকে অনেক পাখিই হারিয়ে গিয়েছিল। তখন সরকার, কৃষক এবং বিজ্ঞানীরা মিলে পাখিদের ফিরিয়ে আনার এক অসাধারণ উদ্যোগ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ধানক্ষেতের চারপাশে ঝোপঝাড় ও জলাশয় তৈরি করে পাখিদের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন। গ্রামের শিশু, নারী এবং কৃষকরা মিলে পাখি রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করে।
সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে "কৃষক থেকে কৃষক" (farmer to farmer) আন্দোলন। এর মাধ্যমে একজন সফল কৃষক তার প্রাকৃতিক চাষের কৌশল অন্য কৃষকদের শিখিয়ে দিতে শুরু করে। এতে খুব দ্রুতই কম্পোস্ট তৈরি, মিশ্র ফসল চাষ এবং পাখির জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জ্ঞান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হলো, যেখানে কীটনাশকের পুরো কাজটিই পাখিরা করে দিচ্ছিল, আর কৃষকরা হয়ে উঠেছিল পাখিদের সবচেয়ে বড় বন্ধু।