রান্নাঘরের ভোজ্যতেল আর আপনার বাজারের ডিম, মাছ বা মাংসের দামের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? আপনি হয়তো অবাক হবেন, কিন্তু এর উত্তর হলো—হ্যাঁ, সরাসরি সম্পর্কযুক্ত! আমদানিকৃত তেলের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা কেবল আমাদের স্বাস্থ্যেরই ক্ষতি করছে না, বরং আমাদের proteína বা আমিষের বাজারকেও আগুন বানিয়ে রেখেছে। চলুন, এই চক্রটি বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
একসময় আমরা স্বনির্ভর ছিলাম
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আশির দশকেও বাংলাদেশ ভোজ্যতেলে প্রায় স্বনির্ভর ছিল। গ্রামের কৃষকেরা প্রচুর পরিমাণে সরিষা, তিল, তিসি, চিনাবাদামের মতো তেলবীজ চাষ করতেন। প্রতিটি গ্রাম বা উপজেলায় ছিল নিজস্ব তেল কল বা ঘানি, যেখানে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং কেমিক্যালমুক্ত উপায়ে তেল উৎপাদন হতো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল, তেল নিষ্কাশনের পর পাওয়া যেত লক্ষ লক্ষ টন খৈল (Oil Cake)। এই খৈল ছিল গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং মাছের জন্য সবচেয়ে সেরা এবং সস্তা প্রোটিনের উৎস। সহজলভ্য খৈলের কারণে পশুখাদ্যের দাম কম ছিল, যার ফলে বাজারে ডিম, দুধ, মাছ এবং মাংসের দামও থাকতো সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। কৃষক, তেলকল মালিক, খামারি—সবাইকে নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চক্র চালু ছিল।
যেভাবে ভেঙে গেল সেই চক্র
এই সুন্দর চক্রটিতে ধস নামে নব্বইয়ের দশকে। যখন বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে এবং সরকারি নীতিমালার সুযোগে কম শুল্কে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি শুরু হয়। বিদেশি তেলের সস্তা দামের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশের হাজার হাজার তেলকল এবং ঘানি বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকেরাও তেলবীজ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আমদানির লুকানো খেসারত: তেল এলো, কিন্তু খৈল গেল কোথায়?
আজ আমরা প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু ভোজ্যতেল আমদানি করি, কিন্তু এর সাথে সেই бесцен্য খৈল আর আসে না। দেশে তেল উৎপাদন হলে আমরা লক্ষ লক্ষ টন খৈল পেতাম, যা দিয়ে আমাদের পশুখাদ্যের চাহিদা মিটতো।
এই খৈলের অভাবে পশুখাদ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। খামারিরা উচ্চ মূল্যে পশুখাদ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আপনার আমার উপর। এ কারণেই গত কয়েক বছরে ডিম, দুধ, মাছ এবং মাংসের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অস্বাস্থ্যকর তেল বেঁচে লাভবান হচ্ছে, দেশ হারাচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, আর জনগণ ভুগছে দ্বিগুণ ক্ষতির শিকার হয়ে—একদিকে অস্বাস্থ্যকর তেল খেয়ে, অন্যদিকে চড়া দামে আমিষ কিনে।
এই চক্র থেকে বেরোনোর উপায় কী?
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আমাদের নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ:
- সরকারি নীতি পরিবর্তন: বিদেশি তেল আমদানির উপর শুল্ক বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদনকে সুরক্ষা দিতে হবে।
- কৃষকদের উৎসাহ প্রদান: দেশীয় তেলবীজ চাষে কৃষকদের ভর্তুকি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে।
- ভোক্তা সচেতনতা: আমাদেরকেই সচেতন হয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত, স্বাস্থ্যকর তেল বেছে নিতে হবে।
আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আমরা যদি দেশের তেলকলগুলোকে আবার পুরোপুরি সচল করতে পারি এবং দেশীয় তেলবীজ উৎপাদনে জোর দিই, তবেই এই চক্র ভাঙা সম্ভব। এর ফলে আমরা শুধু স্বাস্থ্যকর তেলই পাবো না, বরং কম দামে উন্নতমানের মাছ, মাংস, দুধ এবং ডিমও নিশ্চিত করতে পারব।