ভাবুন তো এমন এক ফ্রিজের কথা, যা চালাতে কোনো বিদ্যুৎ লাগে না, কোনো গ্যাস বা রাসায়নিকেরও প্রয়োজন হয় না। এটি চলে শুধুমাত্র পানি দিয়ে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আফ্রিকার বহু দেশে এই জাদুকরী ফ্রিজ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। চলুন, এই অসাধারণ আবিষ্কারের গল্পটি জেনে নেওয়া যাক।
এক অসাধারণ উদ্ভাবক ও তার ‘জিয়ার পট’
এই বিদ্যুৎবিহীন ফ্রিজের উদ্ভাবক হলেন নাইজেরিয়ার একজন শিক্ষক, মোহাম্মদ বাহ আববা। তিনি দেখতেন, তার দেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলো বিদ্যুতের অভাবে তাদের উৎপাদিত শাকসবজি বা অন্যান্য খাবার সংরক্ষণ করতে পারত না। ফলে খাবার দ্রুত পচে যেত এবং কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হতেন। এই সমস্যার একটি সহজ ও সস্তা সমাধান খুঁজতেই তিনি আবিষ্কার করেন ‘জিয়ার পট কুলার’ (Zeer Pot Cooler)।
কীভাবে কাজ করে এই ‘বিদ্যুৎবিহীন’ ফ্রিজ?
এই ফ্রিজটি কাজ করে ‘বাষ্পীভবনীয় শীতলীকরণ’ (Evaporative Cooling) নীতির উপর ভিত্তি করে, যা একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
- এটি বানানোর জন্য দুটি ভিন্ন আকারের মাটির পাত্র নেওয়া হয়—একটি বড় এবং একটি ছোট।
- বড় পাত্রটির ভেতরে ছোট পাত্রটি বসিয়ে, দুটির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটি বালি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়।
- এরপর সেই বালিতে পানি ঢেলে ভালোভাবে ভিজিয়ে দেওয়া হয়।
মূলত, বালি থেকে যখন পানি বাষ্পীভূত হতে শুরু করে, তখন এটি ভেতরের ছোট পাত্রটি থেকে তাপ শোষণ করে নেয়। এর ফলে ভেতরের পাত্রটি ঠান্ডা হয়ে যায় এবং ফ্রিজের মতো কাজ করে। এই সহজ পদ্ধতিতে শাকসবজি, ফলমূল বা দুধের মতো পচনশীল খাবার যেখানে ১-২ দিনেই নষ্ট হয়ে যেত, সেখানে প্রায় ১০-২০ দিন পর্যন্ত সতেজ থাকে।
প্রাচীন জ্ঞান আর আধুনিকতার মেলবন্ধন
এই শীতলীকরণ প্রযুক্তিটি কিন্তু নতুন কিছু নয়। এর ব্যবহার প্রাচীন মিশরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতাতেও দেখা যেত। মোহাম্মদ বাহ আববা এই প্রাচীন জ্ঞান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই একে আধুনিক, সহজলভ্য এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য একটি রূপ দেন। এমনকি তিনি এর নাম ‘জিয়ার পট’ রাখেন আরবি শব্দ ‘জির’ (Zeer) থেকে, যার অর্থ হলো ‘মাটির পাত্র’।
সামান্য এক পাত্রের অসাধারণ প্রভাব
মোহাম্মদ বাহ আববার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পায়। ২০০১ সালে তিনি তাঁর কাজের জন্য সম্মানজনক "Rolex Award for Enterprise" পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি নাইজেরিয়ার হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারের কাছে তার ‘জিয়ার পট কুলার’ পৌঁছে দেন।
তাঁর এই উদ্ভাবন শুধু নাইজেরিয়াতেই নয়, বরং বিশ্বের বহু বিদ্যুৎবিহীন গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। এটি প্রমাণ করে, বড় বড় সমস্যার সমাধান অনেক সময় খুব সাধারণ এবং প্রকৃতিবান্ধব উপায়েও করা সম্ভব।