দোকানের তাক জুড়ে সাজিয়ে রাখা স্বচ্ছ, ঝকঝকে আর গন্ধহীন ‘রিফাইন্ড’ তেল দেখতে বেশ স্বাস্থ্যকর মনে হয়, তাই না? কিন্তু এই "বিশুদ্ধ" তকমাটির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যা স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। চলুন, জেনে নেওয়া যাক আপনার রান্নাঘরের তেলটি কীভাবে তৈরি হয়।
সলভেন্ট এক্সট্র্যাকশন: যেভাবে তৈরি হয় ৯৯% তেল
বাণিজ্যিকভাবে তেল উৎপাদনের সবচেয়ে লাভজনক পদ্ধতির নাম 'সলভেন্ট এক্সট্র্যাকশন'। এই পদ্ধতিতে তেলবীজ গুঁড়ো করে প্রথমে স্টিমে রান্না করা হয়, তারপর এর সাথে মেশানো হয় হেক্সেন (Hexane) এর মতো পেট্রোলিয়াম দ্রাবক। এই রাসায়নিক দ্রাবকটি তেলবীজ থেকে প্রায় ৯৯% তেল নিংড়ে বের করে আনতে পারে, যা কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর জন্য সর্বোচ্চ লাভ নিশ্চিত করে।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় যে কাঁচা তেলটি পাওয়া যায়, তা এতটাই বিষাক্ত যে সরাসরি খাওয়ার योग्य নয়। একে খাওয়ার উপযোগী করার জন্যই শুরু হয় ‘রিফাইনিং’ প্রক্রিয়া।
‘রিফাইনিং’-এর আড়ালে যা যা ঘটে
"রিফাইন্ড" শব্দটি শুনলে शुद्ध বা স্বাস্থ্যকর মনে হলেও, এর ভেতরের গল্পটা ঠিক উল্টো। এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো বিষাক্ত এবং অখাদ্য কাঁচা তেলকে রাসায়নিকের মাধ্যমেดูดี এবং বাজারজাত করার উপযোগী করে তোলা।
- নিউট্রালাইজেশন: কস্টিক সোডা ব্যবহার করে তেলের ফ্যাটি অ্যাসিড দূর করা হয়।
- ব্লিচিং: অ্যাক্টিভেটেড কার্বন বা বিশেষ ধরনের মাটি দিয়ে তেলের প্রাকৃতিক রঙ, ভিটামিন-এ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শোষণ করে ফেলে দেওয়া হয়।
- ডিওডোরাইজেশন: সবশেষে ২০০-২৫০° সেলসিয়াস উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্প দিয়ে তেলের প্রাকৃতিক সুগন্ধ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেওয়া হয়।
এই ভয়ংকর রাসায়নিক পথ পাড়ি দিয়ে যে তেল আমরা পাই, তাতে খালি ক্যালোরি ছাড়া আর কোনো পুষ্টিগুণই অবশিষ্ট থাকে না। উচ্চ তাপে এতে ট্রান্স ফ্যাট তৈরি হয়, যা হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং পেট্রোলিয়াম সলভেন্টের অবশিষ্টাংশ শরীরের জন্য বিষাক্ত হতে পারে।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প: ঘানি এবং এক্সপেলার মেশিন
তাহলে স্বাস্থ্যকর তেল কোনটি? উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের传统 পদ্ধতিতে।
- কোল্ড প্রেস (কাঠের ঘানি): এটি তেল তৈরির সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ পদ্ধতি। এতে কোনো রাসায়নিক বা তাপ ছাড়াই, শুধু চাপের মাধ্যমে তেলবীজ থেকে তেল বের করা হয়। ফলে তেলের প্রাকৃতিক রঙ, গন্ধ, ভিটামিন এবং সমস্ত পুষ্টিগুণ অটুট থাকে। এই পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া খৈলও গবাদিপশুর জন্য উৎকৃষ্ট মানের খাবার।
- হট প্রেস (এক্সপেলার মেশিন): এটিও একটি তুলনামূলক নিরাপদ পদ্ধতি। এতে তেলবীজকে হালকা গরম করে মেশিনের চাপে তেল বের করা হয়। তাপে কিছু পুষ্টিগুণ নষ্ট হলেও এটি রিফাইন্ড তেলের চেয়ে বহুগুণে ভালো।
আপনার করণীয় কী?
সচেতন ভোক্তা হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো শিল্পজাত বিষকে প্রত্যাখ্যান করা। চকচকে, গন্ধহীন এবং পাতলা রিফাইন্ড তেলের বদলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ঘানি বা এক্সপেলার মেশিনের তেল বেছে নিন। এই তেলগুলো দেখতে হয়তো একটু ঘন বা রঙিন হবে, কিন্তু এটাই এর প্রাকৃতিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ হওয়ার প্রমাণ।
আপনার এই একটি সিদ্ধান্ত শুধু আপনার এবং আপনার পরিবারের স্বাস্থ্যকেই সুরক্ষিত করবে না, বরং দেশের স্থানীয় ও স্বনির্ভর অর্থনীতিকেও সচল রাখতে সাহায্য করবে।