খেসারি ডাল—গ্রামবাংলার অতি পরিচিত একটি খাবার। সস্তা, সহজলভ্য এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় যুগ যুগ ধরে এটি সাধারণ মানুষের প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই ডালকে ঘিরে রয়েছে এক অন্ধকার ইতিহাস আর পঙ্গুত্বের ভয়। আসলেই কি খেসারি ডাল খাওয়া বিপজ্জনক? চলুন, এর পেছনের পুরো গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।
এক ডালে শত পদ: বাংলার ঘরে ঘরে খেসারি
খেসারি ডাল বা কলাই যেকোনো জলবায়ুতে খুব সহজে এবং কম খরচে ফলে। এ কারণেই অতীতে ಬರ বা খরার মৌসুমে কৃষকরা প্রচুর পরিমাণে এর চাষ করত। গ্রামবাংলার একজন সাধারণ গৃহিণী এই এক ডাল দিয়েই দুপুরের খাবার সাজিয়ে ফেলতেন—খেসারির খিচুড়ি, তেঁতুল দিয়ে ঝোল, ভর্তা, পেঁয়াজু কিংবা ডালভাজি। ২০-৩০ শতাংশ প্রোটিন থাকায় এটিকে "গরীবের মাংস" বা "গাছন্ত মাংস" বলা হতো।
ইতিহাসের কালো অধ্যায়: যখন খেসারি ছিল অত্যাচারের হাতিয়ার
খেসারি ডালের পুষ্টিগুণের আড়ালে একটি ভয়ংকর দিকও রয়েছে। এতে থাকা β-ODAP নামক একটি নিউরোটক্সিনের কারণে এটি যদি একমাত্র খাবার হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া হয়, তবে ‘ল্যাথিরিজম’ বা পায়ের প্যারালাইসিস হতে পারে।
ইতিহাসে এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে শোষকেরা। ১৯৪২ সালে নাৎসিরা ইউক্রেনের এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি বন্দিদের খাবার হিসেবে শুধু খেসারি ডাল দিত। অন্য কোনো খাবার না থাকায় বেঁচে থাকার জন্য তারা সেটিই খেত, যার ফলে প্রায় ১,২০০ বন্দি পঙ্গু হয়ে যায়। একইভাবে, ভারতের জমিদাররা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা না দিয়ে সস্তা খেসারি ডাল দিত। সেই ডাল বিক্রি করে অন্য খাবার কেনার উপায় ছিল না। ফলে শ্রমিকেরা বাধ্য হয়ে শুধু খেসারি খেয়েই দিন কাটাত এবং একসময় ল্যাথিরিজমে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করত।
খেসারি খেলেই কি পা পঙ্গু হয়ে যায়?
এই প্রশ্নটি নিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেন। ভারতের ড. বিজয়নাথ মিশ্র উত্তর প্রদেশের প্রায় ৯ হাজার মানুষের উপর একটি গবেষণা চালান, যাদের খাবারের বড় একটি অংশ ছিল খেসারি ডাল। কিন্তু তাদের মধ্যে পঙ্গুত্ব বা পা কাঁপার কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি।
তার গবেষণায় বেরিয়ে আসে, খেসারি ডাল খেলেই ল্যাথিরিজম হয়—এই ধারণাটি পুরোপুরি সত্য নয়। শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষ বা শোষণের শিকার হয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যখন খেসারি ডালই একমাত্র খাবার হয়ে ওঠে, তখনই এই রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়। স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে, অর্থাৎ ভাত, রুটি বা অন্য খাবারের সাথে খেলে এতে কোনো ঝুঁকিই নেই।
যেভাবে খেসারি খাবেন নিশ্চিন্তে
আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, যদি খেসারি ডাল রান্নার আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় এবং সেই পানি ফেলে দিয়ে ভালোভাবে রান্না করা হয়, তাহলে এর মধ্যে থাকা ক্ষতিকর উপাদান প্রায় পুরোটাই চলে যায়।
বাস্তবে কেউই প্রতিদিনের মোট খাবারের অর্ধেক অংশজুড়ে টানা তিন থেকে ছয় মাস শুধু খেসারি ডাল খায় না। তাই সাধারণ জীবনে, আর দশটা ডালের মতো খেসারি খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ। এর অন্ধকার ইতিহাসটি মূলত খাবারের নয়, বরং মানুষের তৈরি করা শোষণ আর দুর্ভিক্ষের।