বাংলাদেশে প্রতি বছর গ্যাস্ট্রিকের ঔষধের বাজার প্রায় ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার! কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হজমের সমস্যায় ভুগছেন? এর উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে আপনার রান্নাঘরে রাখা স্বচ্ছ, ঝকঝকে ব্র্যান্ডেড রিফাইন্ড তেলের বোতলে।
‘রিফাইন্ড’ তেলের আড়ালে ভয়ংকর রাসায়নিক প্রক্রিয়া
বাণিজ্যিকভাবে তেল তৈরির সবচেয়ে লাভজনক কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পদ্ধতির নাম 'সলভেন্ট এক্সট্র্যাকশন'। এই পদ্ধতিতে হেক্সেন (Hexane)-এর মতো পেট্রোলিয়াম দ্রাবক ব্যবহার করে তেলবীজ থেকে প্রায় ৯৯% তেল নিংড়ে বের করা হয়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর জন্য এটি সর্বোচ্চ লাভজনক হলেও, এই প্রক্রিয়ায় যে কাঁচা তেল পাওয়া যায় তা সরাসরি খাওয়ার অযোগ্য এবং বিষাক্ত।
এই বিষাক্ত তেলকে বাজারজাত করার জন্যই শুরু হয় ‘রিফাইনিং’ প্রক্রিয়া। কস্টিক সোডা, অ্যাক্টিভেটেড কার্বন এবং ২০০-২৫০° সেলসিয়াস উচ্চ তাপমাত্রার মাধ্যমে তেলটিকে যথাক্রমে নিউট্রালাইজ, ব্লিচ এবং ডিওডোরাইজ করা হয়। এই ভয়ংকর রাসায়নিক পথ পাড়ি দিয়ে তেল তার সমস্ত প্রাকৃতিক ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, রঙ এবং গন্ধ হারিয়ে এক পুষ্টিহীন তরলে পরিণত হয়।
যেভাবে আপনার পাকস্থলী ধ্বংস করছে এই তেল
"রিফাইন্ড" তেল আমাদের পাকস্থলীর জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই তেল খেলে তা আমাদের গাট লাইনিং বা পাকস্থলীর ভেতরের প্রাচীরকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একবার এই সুরক্ষা প্রাচীর নষ্ট হয়ে গেলেই শুরু হয় গ্যাস্ট্রিক, আলসার, আইবিএস, অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা।
পাশাপাশি, রিফাইনিং প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া ট্রান্স ফ্যাট হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, ই, কে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমরা খালি ক্যালোরি ছাড়া আর কিছুই পাই না।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প কোনটি? ফিরে আসুন ঐতিহ্যে
তাহলে স্বাস্থ্যকর তেল কোনটি? উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যে।
- কোল্ড প্রেস (কাঠের ঘানি): এটি তেল তৈরির সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি। এতে কোনো রাসায়নিক বা তাপ ছাড়াই, শুধু চাপের মাধ্যমে তেলবীজ থেকে তেল বের করা হয়, ফলে এর সমস্ত পুষ্টিগুণ অটুট থাকে।
- হট প্রেস (এক্সপেলার মেশিন): এটিও একটি তুলনামূলক নিরাপদ পদ্ধতি, যা রিফাইন্ড তেলের চেয়ে বহুগুণে ভালো।
আপনার করণীয়: স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি দুটিই বাঁচান
সচেতন ভোক্তা হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো এই শিল্পজাত বিষকে প্রত্যাখ্যান করা। ঝকঝকে, গন্ধহীন রিফাইন্ড তেলের বদলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ঘানি বা এক্সপেলার মেশিনের তেল বেছে নিন। এই তেল দেখতে হয়তো একটু ঘন বা রঙিন হবে, কিন্তু এটাই এর প্রাকৃতিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ হওয়ার প্রমাণ।
আপনার এই একটি সিদ্ধান্ত শুধু আপনার পরিবারের স্বাস্থ্যকেই সুরক্ষিত করবে না, বরং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার ঔষধের ব্যবসাকে চ্যালেঞ্জ করে একটি সুস্থ ও স্বনির্ভর অর্থনীতিকেও সচল রাখতে সাহায্য করবে।