অল্প কিছু দিন আগেও আমাদের দেশের বাজারগুলোতে যে চাল পাওয়া যেত, তার স্বাদ, গন্ধ এবং পুষ্টিগুণ ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই চাল এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো চাল উৎপাদনের দুটি ভিন্ন পদ্ধতি—ঐতিহ্যবাহী হাস্কিং মিল এবং আধুনিক অটো রাইস মিল। চলুন, এই দুই ধরনের মিলের পার্থক্য এবং আমাদের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব জেনে নেওয়া যাক।
হাস্কিং মিলের চাল: পুষ্টি আর স্বাদের ঐতিহ্য
হাস্কিং মিল হলো হাজার হাজার ছোট চালকল, যা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে ধান শুকিয়ে চাল তৈরি করে। এই পদ্ধতিতে ধান ভাঙানোর সময় চালের উপরের লালচে আবরণ বা ব্র্যান (Bran) স্তরটি নষ্ট হয় না। এই ব্র্যান স্তরেই চালের আসল পুষ্টি—ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ—লুকিয়ে থাকে।
হাস্কিং মিলের চালের ভাত রান্না হতে একটু বেশি সময় লাগে এবং পেটে বেশিক্ষণ থাকে, ফলে সহজে ক্ষুধাও পায় না। এর প্রাকৃতিক স্বাদ ও ঘ্রাণ অতুলনীয়। তবে পুষ্টিগুণ অক্ষত থাকায় এই চালে পোকা ধরে এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা একটি প্রাকৃতিক খাবারেরই লক্ষণ।
অটো রাইস মিলের চাল: আধুনিকতা কি স্বাস্থ্যের শত্রু?
আধুনিক অটো রাইস মিলে খুব কম সময়ে এবং অল্প শ্রমিকে বিপুল পরিমাণ চাল উৎপাদন করা যায়। এই চাল দেখতে ধবধবে সাদা এবং চকচকে হয়। এর কারণ হলো, আধুনিক মেশিনের সাহায্যে চালকে এমনভাবে পলিশ করা হয় যে এর উপরের ব্র্যান এবং জার্ম (Germ) স্তরটি পুরোপুরি দূর হয়ে যায়।
এর ফলে চাল দেখতে সুন্দর হয়, পোকা ধরে না এবং খুব দ্রুত রান্নাও হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় চাল তার সমস্ত ফাইবার, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং প্রাকৃতিক স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে এক পুষ্টিহীন শ্বেতসারে পরিণত হয়।
শুধু চাল নয়, হারাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও
অল্প কয়েকটি অটো রাইস মিলের বিপুল উৎপাদন ক্ষমতার সাথে পাল্লা দিতে না পেরে দেশের হাজার হাজার ঐতিহ্যবাহী হাস্কিং মিল আজ বন্ধের পথে। এর ফলে শুধু যে আমরা পুষ্টিকর চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি তাই নয়, এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে।
যখন পুরো দেশের চালের বাজার হাতে গোনা কয়েকটি অটো রাইস মিলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন একচেটিয়া বা মনোপলি ব্যবসা তৈরি হয়। এর ফলে কৃষকরা যেমন ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি সাধারণ মানুষকেও চড়া দামে পুষ্টিহীন চাল কিনে খেতে হয়।
আপনার প্লেটে কোনটি বেছে নেবেন?
এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি কি আধুনিকতার নামে চকচকে, দেখতে সুন্দর কিন্তু পুষ্টিহীন চাল বেছে নেবেন? নাকি ঐতিহ্যবাহী, সামান্য লালচে কিন্তু পুষ্টিগুণে ভরপুর হাস্কিং মিলের চালকে ফিরিয়ে আনবেন?
আমাদের এই একটি সচেতন সিদ্ধান্তই পারে দেশের কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং সাধারণ মানুষের কাছে পুষ্টিকর চাল পৌঁছে দিতে। পুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়াই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য।