প্রযুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আমাদের জীবনযাপনের ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা বা অবসরের কাজগুলো শুধু বিনোদনের জন্য ছিল না, বরং তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের অংশ ছিল। কিন্তু আজ, সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে এক ভার্চুয়াল জগৎ, যা আমাদের এক অদ্ভুত আসক্তির চক্রে বেঁধে ফেলছে।
কেন আমরা ভার্চুয়াল জগতে আসক্ত হচ্ছি?
আজকের তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশই ভিডিও গেম, টিভি সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজের মতো মাস-এন্টারটেইনমেন্টে আসক্ত। এর পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে:
- বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা: ছেলেদের বাস্তব জীবনে খেলাধুলা বা শরীরচর্চার মতো পুরুষোচিত কাজ এবং মেয়েদের হস্তশিল্প বা বাগান করার মতো সৃজনশীল কাজ থেকে দূরে সরে আসা।
- একাকীত্ব ও অলস সময়: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে মানুষের হাতে এখন প্রচুর অলস সময় এবং তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ।
- ব্যক্তিগত ডিভাইস: প্রত্যেকের হাতে নিজস্ব মোবাইল বা কম্পিউটার থাকায়, তারা খুব সহজেই নিজের ব্যক্তিগত জগতে ডুব দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
সাফল্যের ‘মিথ্যা সান্ত্বনা’ এবং আসক্তির চক্র
মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হলো নিজের योग्यता প্রমাণ করা এবং সাফল্য অর্জন করা। আধুনিক বিনোদন মাধ্যমগুলো এই প্রবৃত্তিকে পুঁজি করেই তাদের ফাঁদ তৈরি করে।
- ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে: খেলার সময় একজন গেমার নিজেই গল্পের নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট হয়ে ওঠে। যখন সে কোনো মিশন সফল করে বা রেসে প্রথম হয়, তখন সে বাস্তব জীবনের সাফল্যের মতোই এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে। এটি আসলে বাস্তব জীবনের অক্ষমতা বা আলস্যকে ঢাকার জন্য এক ধরনের ‘মিথ্যা সান্ত্বনা’।
- মুভি বা সিরিয়ালের ক্ষেত্রে: দর্শকরা প্রায়ই নিজেদেরকে গল্পের নায়কের জায়গায় কল্পনা করে। নায়কের সাফল্য বা রোমান্স দেখে তারা ভার্চুয়ালি নিজেদের অপূর্ণ ফ্যান্টাসি পূরণ করার চেষ্টা করে।
এভাবেই এক ভয়ংকর চক্র বা ‘লুপ-হোল’ তৈরি হয়। যে মানুষ বাস্তব জীবনের দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ থেকে যত দূরে সরে যায়, সে তত বেশি ভার্চুয়াল বিনোদনে আশ্রয় খোঁজে। আবার, এই ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত সময় দেওয়ার ফলে সে বাস্তব জীবনের জন্য আরও অযোগ্য হয়ে পড়ে। একটি অন্যটির কারণ এবং ফলাফল।
কল্পনা বনাম বাস্তবতা: ফাঁদ থেকে বেরোবেন কীভাবে?
কল্পনা করা বা স্বপ্ন দেখা কোনো সমস্যা নয়, বরং এটি খুবই জরুরি। সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপ বা ‘রিয়েল অ্যাকশন’ নেওয়া হয় না এবং ব্যক্তি তার কমফোর্ট জোনে আটকে থাকে।
বাস্তব জীবনে সক্ষমতা অর্জনের জন্য চেষ্টা এবং সময় দুটিই প্রয়োজন। ভার্চুয়াল জগতের কৃত্রিম সাফল্য আপনাকে সাময়িক আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু তা কখনোই বাস্তব অর্জনের তৃপ্তি দিতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই শুধু কল্পনা করে নয়, বরং সেই কল্পনার সাথে বাস্তব পদক্ষেপ যোগ করেই আমরা জীবনে যা চাই, তাই হতে পারি।
জীবন একটাই। একে ভার্চুয়াল জগতে নয়, বাস্তবতায় উপভোগ করতে শিখুন।