৪০ হাজার টন—এই ওজনটি কতটা বিশাল, তা কি আপনি কল্পনা করতে পারেন? এটি প্রায় ৮ হাজার আফ্রিকান হাতির মোট ওজনের সমান! আর ভয়ংকর সত্য হলো, বাংলাদেশের কৃষিজমিতে প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ কীটনাশক বা পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমাদের মাটি, পানি এবং শরীরকে বিষাক্ত করে চলেছে।
হাজার কোটি টাকার বিষের ব্যবসা
কৃষিজমিতে ব্যবহৃত এই কীটনাশকের প্রায় ৯৮ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, আমদানি থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত দেশে কীটনাশকের বাজার প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার!
সিনজেন্টা, বায়ারের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই বিশাল ব্যবসা থেকে লাভবান হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বাজারে প্রায় ৫ হাজারের বেশি রকমের কীটনাশক পাওয়া যায়, যার অনেকগুলোই উন্নত বিশ্বে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো রকম পর্যবেক্ষণ ছাড়াই এগুলো মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে এবং কৃষকরা অবাধে ব্যবহার করছেন।
জিএমও ফসল এবং কীটনাশকের অশুভ আঁতাত
কীটনাশকের ব্যবহার এতটা বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো জিএমও (GMO) ফসল। এই ফসলগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে নির্দিষ্ট কিছু আগাছানাশক (Herbicide) প্রয়োগ করলেও ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। এর ফলে কৃষকরা জমিতে আগাছা দমনের জন্য আরও বেশি পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়।
যেমন, মনসান্টোর তৈরি গ্লাইফোসেট (Roundup) বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে। এর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এমন "সুপার উইড" বা সুপার আগাছার জন্ম হচ্ছে যা দমন করতে আরও শক্তিশালী এবং আরও বেশি কীটনাশকের প্রয়োজন পড়ছে। এভাবেই আমরা এক ভয়াল চক্রে আটকে যাচ্ছি।
মাটি থেকে শরীরে: বিষের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
জমিতে প্রয়োগ করা এই রাসায়নিকগুলো কখনোই পুরোপুরি নষ্ট হয় না। এগুলো মাটি, পানি এবং বাতাসে মিশে যুগ যুগ ধরে থেকে যায়। খাবারের মাধ্যমে এই বিষ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর প্রভাবে কিডনি ও লিভারের রোগ, ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি এবং প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে কীটনাশকের প্রভাবে মানুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা প্রায় ৪২ শতাংশ কমে গেছে!
বিশ্ব যখন ‘না’ বলছে, আমরা কি ঘুমাচ্ছি?
জিএমও ফসল এবং কীটনাশকের এই ভয়ংকর প্রভাবের কারণে বিশ্বের বহু দেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। রাশিয়া, সৌদি আরব, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশ জিএমও ফসল চাষ বা আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে এই বিষের বাজার ক্রমাগত বাড়ছে এবং জিএমও ফসল خاموشে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে গ্রাস করতে চলেছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই নীরব ঘাতকের ব্যাপারে আমরা কি আদৌ সচেতন?