পুষ্টির অতিরিক্ত ভগ্নাংশ: ভিটামিন, মিনারেল ও স্বাভাবিক খাবারের গুরুত্ব

পুষ্টির অতিরিক্ত ভগ্নাংশ: ভিটামিন, মিনারেল ও স্বাভাবিক খাবারের গুরুত্ব
১৯ শতকের শেষ ও ২০ শতকের শুরুতে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করত, মানুষের পুষ্টির জন্য শুধু প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, চর্বি এবং জলই যথেষ্ট।
কিন্তু ব্রিটিশ বায়োকেমিস্ট Frederick Gowland Hopkins এই ধারণার বিরুদ্ধে ১ম গবেষণা শুরু করেন।

হপকিন্স বুঝেছিলেন, শুধু এই পুষ্টি উপাদানগুলোই প্রাণীর স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। খাদ্যে আরও কিছু অত্যাবশ্যকীয় উপাদান থাকতে হবে।
তিনি লক্ষ্য করেন, শুধুমাত্র এই ৩/৪টি প্রধান পুষ্টি উপাদান থাকলে জীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়না, তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, রোগে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে!

ফ্রেডরিক হপকিন্স তার ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, ইঁদুরকে পেট ভরে খেতে দেয়ার পরও তাদের শরীর জীর্ণশীর্ণই থেকে যায়।
কিন্তু একই ইঁদুরের খাদ্যে সামান্য একটু গরুর দুধ যোগ করলেই ইঁদুরগুলোর শারীরিক বৃদ্ধি বহুগুণ বেড়ে যায়।

এই গবেষণা থেকে হপকিন্স বুঝতে পারেন, গরুর দুধে এমন একটা উপাদান আছে, যা ইঁদুরের শরীরে নিজে নিজে সংশ্লেষণ হয়না।

গবেষণার সময়, হপকিন্স তার ল্যাবরেটরিতে একদল ইঁদুরকে শুধু বিশুদ্ধ প্রোটিন (ক্যাসেইন), কার্বোহাইড্রেট (স্টার্চ), চর্বি, লবণ ও জল দিয়ে তৈরি খাদ্য দিয়েছিলেন।
তাত্ত্বিকভাবে, এসবই শরীরের শক্তি ও গঠনে প্রয়োজনীয় উপাদান।
কিন্তু দেখা গেল, ইঁদুরগুলো পেট ভরে খেয়ে বেঁচে থাকলেও তাদের দেহ জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে, দৈহিক বৃদ্ধি নেই ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

এরপর, যখন তিনি একই খাদ্যের সাথে অল্প পরিমাণে গরুর দুধ মেশালেন, তখন ইঁদুরগুলো দ্রুত বেড়ে উঠতে শুরু করে, সুস্থ হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিক শারীরিক গঠন পায়।
এটি প্রমাণ করল যে, দুধে কিছু অজানা উপাদান আছে।

প্রোটিন, চর্বি ও শর্করা বাদেও খাদ্যে কিছু অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান আছে। শরীর এসব উপাদান নিজে তৈরি করতে পারে না। তাই বাইরে থেকে খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়।

হপকিন্স গরুর দুধের রাসায়নিক বিশ্লেষণ শুরু করেন এবং কিছু অ্যামিনের (-NH2) অস্তিত্ব খুঁজে পান। এসব অ্যামিন প্রাণী দেহের বৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় (ভাইটাল)। এই উপাদানগুলোকে প্রথমে accessory food factors নাম দেন। পোলিশ বায়োকেমিস্ট Casimir Funk এই যৌগগুলোর নাম দিয়েছিল- ভাইটাল অ্যামিন (Vital Amine)।

পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করল যে, সব ভিটামিনের মধ্যে অ্যামিনো গ্রুপ নেই (যেমন ভিটামিন সি), তখন নামটি সংক্ষিপ্ত করে Vitamin রাখা হয়।

হপকিন্সের এই আবিষ্কার প্রমাণ করল, শুধু প্রোটিন-কার্বোহাইড্রেট-চর্বি নয়, অণুপুষ্টিও (Micronutrients) স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
তাঁর কাজ অ্যাভিটামিনোসিসের, যেমন স্কার্ভি (ভিটামিন সি-র অভাব), রিকেটস (ভিটামিন ডি-র অভাব), বেরিবেরি (ভিটামিন বি১-র অভাব) ইত্যাদির কারণ বুঝতে সাহায্য করেছিল। ১৯২৯ সালে হপকিন্সকে মেডিসিনে নোবেল দেওয়া হয়।
...

মূলত ১৯ শতকের শেষ ও ২০ শতকের শুরুতে ইউরোপীয় ও পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করত, মানুষের পুষ্টির জন্য শুধুমাত্র প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, চর্বি, খনিজ লবণ এবং জলই যথেষ্ট। এই ধারণাটি তখনকার প্রধান বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অংশ ছিল, বিশেষত জার্মানি, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের ল্যাবরেটরিগুলোতে। ইউরোপে Justus von Liebig এর মতো বিজ্ঞানীরা প্রোটিন-কার্বোহাইড্রেট-চর্বির তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসাপদ্ধতিতে ভিটামিনের গুরুত্ব স্বীকৃত ছিল। অন্যান্য সংস্কৃতিতে ভিটামিনের জ্ঞান বিদ্যমান ছিল হাজার হাজার বছর ধরে।

চীন ও জাপানে চালের ত্বক (ব্র্যান) খেয়ে বেরিবেরি রোগ (ভিটামিন B১-র অভাব) প্রতিরোধের রীতি ছিল।
আয়ুর্বেদে রাতকানা রোগ (ভিটামিন A-র অভাব) প্রতিরোধে ঘি ও গাজর খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো।
প্রাচীন মিশরীয়রা রাতকানা রোগের চিকিৎসায় গরুর যকৃত (ভিটামিন A সমৃদ্ধ) ব্যবহার করতো।

এই সমস্ত ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ছিলনা, তাই ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা সেগুলোকে উপেক্ষা করত। 

অন্যান্য সংস্কৃতিতে ভিটামিনের উপকারিতা সম্পর্কে প্রাচীন জ্ঞান ছিল। হপকিন্স একে আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানের অংশ করে তোলে।
তাঁর গবেষণা ইউরোপকেন্দ্রিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রমাণ দিয়েছিল, শুধু ক্যালোরি নয় ভিটামিনও অপরিহার্য। এগুলো শরীরে তৈরি হয় না, তাই খাদ্য থেকে পেতে হয়। 
...

বিশুদ্ধ খাদ্য (প্রোটিন, চর্বি, শর্করা) খেয়ে প্রাণীর ক্ষুধা মিটলেও অতিরিক্ত রোগ, স্থূলতা, শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়া ও মৃত্যু কেন হচ্ছে, তা বোঝা যায় হপকিন্স সাহেবের রিসার্চ থেকে।

রিফাইন্ড বা প্রসেসড খাবার মানুষদেরকে হপকিন্সের ল্যাবরেটরির সেই ইঁদুরদের মতো অবস্থায় ফেলছে। মানুষ প্রতিদিন রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (সাদা ভাত, রুটি, মুড়ি, চিনি) এবং প্রসেসড ফ্যাট (ভেজিটেবল অয়েল) খাচ্ছে।
সবার পেট ভরা থাকলেও ভিটামিন-মিনারেলের ঘাটতি পূরণ হচ্ছেনা। পুষ্টির অভাবে মেটাবলিক সিনড্রোম (ডায়াবেটিস, ওবেসিটি), অটোইমিউন রোগ (থাইরয়েড, আর্থ্রাইটিস), ক্লান্তি (Fatigue) ও হরমোনাল ইমব্যালান্স হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তা বুঝতেও পারছেনা!

রিফাইন্ড বা প্রসেসড খাবারগুলো থেকে প্রাকৃতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান (ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার, এনজাইম ইত্যাদি) নষ্ট হয়ে যায় বা সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে আপনি ক্যালোরি পান ঠিকই, কিন্তু তা নির্জীব ক্যালোরি (empty calories)।
(পাশাপাশি শেল্ফ লাইফ বাড়াতে কেমিক্যালস প্রয়োগ করা হয়।)

এর ফলাফল: শরীর গঠন দুর্বল হয়, শিশুদের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় (বারবার অসুস্থ হওয়া), মনের ওপর প্রভাব পড়ে (ক্লান্তি, মেজাজ খারাপ, মনোযোগ কমে যাওয়া), জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ে (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা) ইত্যাদি।

মানুষ হপকিন্সের ইঁদুরদের মতো পেট ভরে খালি ক্যালোরি খাচ্ছে, খেয়ে ভরপেট থাকলেও পুষ্টির অভাবে ভুগছে।
এর সমাধান হলো, প্রাকৃতিক ও অপরিশোধিত খাবারে ফিরে যাওয়া, যেমন আমাদের পূর্বপুরুষরা খেতেন!

- Whole Food: প্রসেসবিহীন বা কম প্রসেস করা প্রাকৃতিক খাবার খান। কালার্ড রাইস (লাল চাল, কালো চাল), হোলগ্রেইন গমের আটা, হোলগ্রেইন যব, যাঁতায় মিলিং করা ডাল, দেশি শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস-ডিম-দুধ খান।

- Traditional Fat: খাঁটি ঘি, দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত নারকেল তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল ব্যবহার করুন।

- Mineral-rich Salt: ব্ল্যাক সল্ট, পিংক সল্ট, অপরিশোধিত সীসল্ট ব্যবহার করুন। অপরিরোধিত লবণে থাকে প্রাকৃতিক আয়োডিন ও ১০০য়ের কাছাকাছি মিনারেল।

- Natural Supplements: প্রাকৃতিক উৎস (যেমন, বাদাম, বীজ, স্প্রাউটস, ছাতু, খেজুর, মধু, যব) থেকে ভিটামিন ও মিনারেল গ্রহণ করুন।

Muhammad Rahat Khan

Source

Comments

0 total

Be the first to comment.

More from this User

View all posts by Alamin
প্রাকৃতিক উপায়ের মাধ্যমে ত্বক ও স্বস্থ্য রক্ষার ঐতিহ্য ও বিজ্ঞান প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

প্রাকৃতিক উপায়ের মাধ্যমে ত্বক ও স্বস্থ্য রক্ষার ঐতিহ্য ও বিজ্ঞান প্রসঙ্গে

ত্বকে অসংখ্য ভালো ও খারাপ ব্যাকটেরিয়া পরস্পর ঝামেলা না করে বসবাস করে। এরা ব্যালেন্স রেখে চলে, বর্জ্য...

Aug 17, 2025
আজাদের সংগ্রামের ইতিহাস: ৪৭ সালের স্বাধীনতা ও মুসলমান দলের প্রাপ্তি ইসলামের ইতিহাস

আজাদের সংগ্রামের ইতিহাস: ৪৭ সালের স্বাধীনতা ও মুসলমান দলের প্রাপ্তি

এক সময় এই দেশে মুসলমানের ছেলেদের রাস্তা ছেড়ে দিতে হত।শুধু মুসলমান হওয়ার "অপরাধে"।বানিয়ে বানিয়ে বলছি...

Aug 17, 2025